বিশেষ প্রতিবেদনঃ
সৈয়দ মুন্তাছির রিমন————————–
পাহাড়ী ঝর্ণা, হাকাঁলুকির নয়াভিরাম দৃর্শ্য আতরের সুগন্ধে ভরপুর প্রান্তিক জনপদ বড়লেখার সাংবাদিকতায় জড়িয়ে আছে একটি নাম, কাজী রমিজ উদ্দিন।
তিনি অনন্য এ কারণে যে, আর দশজন সাংবাদিকের চাইতে তিনি অনেকটা আলাদা, গতানুগতিকথার বাইরে বিস্তৃত তাঁর পেশাদারিত্বের পরিসর, বিচিত্র তাঁর অনুরাগ, বন্ধুর তাঁর পথ পরিক্রমা। নানাবিধ দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের স্বীকার হয়েও তিনি বস্তুনিষ্ট সংবাদ পরিবেশনে দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন- মানব সভ্যতার জন্য কল্যাণকামী সব পেশাই মহৎ হলেও সাংবাদিকতা পেশার দায়িত্ববোধ আরেকটু ব্যাপক। বস্তুনিষ্ট ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার মাধ্যমে প্রকাশিত হয় শোষিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা, বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের কথা। সৎ সাংবাদিকতা সমাজকে কলুষমুক্ত করে, সভ্যতাকে আলোকিত করে। এ আদর্শকে ধারণ করেই বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে বড়লেখার সমস্যা ও সম্ভাবনার কথাগুলোকে বস্তুনিষ্টভাবে স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি স্থানীয়, সামাজিক ও সংস্কৃতিক বলয়েও তিনি একজন সফল সংগঠক হিসেবে সুপরিচিত।
তাঁর পুরো নাম কাজী রমিজ উদ্দিন, তবে সবার কাছে “সাংবাদিক রমিজ” নামেই তিনি অধিক পরিচিত। জন্ম ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে বড়লেখা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম দৌলতপুরে। পিতা মাওলানা কাজী আফসার উদ্দিন ও মাতা রায়হানা বেগম। কৈশোরে তিনি মা’কে হারান। তাঁর পিতা মৃত কাজী আফসার উদ্দিন জীবনকালে নিকাহ্ রেজিষ্ট্রারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দৌলতপুর বাজারে ফার্মেসী ব্যবসা এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিতে যুক্ত ছিলেন। ভাই বোনদের মধ্যে তিনি তৃতীয়। মায়ের মৃত্যুর পর অকৃত্রিম পিতৃস্নেহ আর বড় ভাই-বোনের আদর যত্নে তিনি লালিত হন। বাবার হাত ধরেই দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জীবনধর্মী শিক্ষার্জন ও লেখালেখির হাতেখড়ি হয় তাঁর। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন- “শৈশব থেকেই আমার ভেতরে অজানাকে জানার অদম্য এক কৌতুহল কাজ করত”। আমার বাবা বরাবরই সে উৎসাহ দিতেন। বাবা ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের একনিষ্ঠ পাঠক। আমৃত্যু তিনি ইত্তেফাক পাঠ করেছেন। তিনি আমাকে দিয়ে ইত্তেফাকের খবর ও শিশুতোষ লেখা পাঠ করাতেন। নিজে চোখ বন্ধ করে সেগুলো শুনতেন। ভূল হলে শুধরে দিতেন। আমার জন্য ছড়া, কবিতা ও অন্যান্য শিশুতোষ বই নিয়ে আসতেন। লেখালেখির জন প্রেরণা যোগাতেন। বাবার উৎসাহে আমি দৈনিক ইত্তেফাকের কঁচি কাচার আসরের সদস্য হয়ে গেলাম এবং এখানেই আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়।
পরিবারের গন্ডির বাইরে “দৌলতপুর সরকারী প্রার্থমিক বিদ্যালয়ে” ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের শুরু। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর পর বাবার ইচ্ছায় তিনি ঐতিহ্যবাহী পরগনাহী দৌলতপুর সিনিয়র আলিম মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং সেখান থেকে দাখিল ও আলিম সম্পন্ন করেন। ২০০০ সালে আলিম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরপরই স্থানীয় দৌলতপুর ও তৎপার্শ্ববর্তী গ্রামের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রাকে বেগবান করার লক্ষ্যে এলাকার যুবকদের নিয়ে গঠন করেন “দৌলতপুর দিশারী সমাজ কল্যাণ পরিষদ”। এই সংগঠনের ব্যানারে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান গরীব মেধাবীদের সাহায্য প্রদানসহ অন্যান্য সামাজিক ও সাস্কৃতিক কার্যক্রম বৃহত্তর বড়লেখাবাসীর কাছে ব্যাপক ভাবে প্রশংসিত হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন- মূলত এই সংগঠনের দায়িত্বপালনের মাধ্যমেই আমার ভেতর মানুষের জন্য কাজ করার এক অদম্য স্পৃহা সৃষ্টি হয় যা আমার সামাজিক দায়িত্ববোধকে জাগিয়ে তোলে। সেই থেকেই এই অঞ্চলের বিভিন্ন সৃজনশীল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়ি। সামাজিক সংগঠনের দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে প্রেস রিলিজের সুবাদে তিনি সিনিয়র সাংবাদিক মহলের সাথে পরিচিত হন। তাদের মধ্যে আবদুল কাদের তাপাদার, তাইছির মাহমুদ ও মরহুম আব্দুর রাজ্জাক অন্যতম। তাদের সহচর্য ও অনুপ্রেরণায় সাংবাদিকতার পথ চলা শুরু হলেও সাংবাদিকতার প্রতি তাঁর অনুরাগ সেই শৈশব থেকে।
মূলত কাজী রমিজের সাংবাদিকতা শুরু হয় ২০০৩ সালে দৈনিক সংগ্রামের একজন শিক্ষানবিশ সাংবাদিক হিসেবে। তারও আগে তিনি সিলেটের বিভিন্ন স্থানীয় পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। তার মধ্যে বড়লেখার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক বড়লেখা, সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয়, মাসিক সিলেটবাজার উল্লেখযোগ্য। ২০০৪ ই সালে তিনি দৈনিক সংগ্রামের বড়লেখা উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন এবং এখন পর্যন্ত বহাল আছেন।
এদেশে শুধু কর্মস্থলের ভিন্নতার কারণে সাংবাদিকদের দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সাংবাদিক ও মফস্বল সাংবাদিক। মফস্বল সাংবাদিকরা একে তো প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত, তার উপর শহুরে সাংবাদিকদের তুলনায় তাদের জীবনের ঝুকিটাও অনেক বেশি। প্রভাবশালী রাজনৈতিব ব্যক্তি কিংবা পুলিশ প্রশাসনের ভয়ে প্রায় তাদের তটস্থ থাকতে হয়। ‘সাদা কে সাদা’ আর ‘কালো কে কালো’ বলার অপরাধে কাজী রমিজকেও বিভিন্ন মহলের দমন পীড়নের স্বীকার হতে হয়েছে। এমনকি পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে তিনি শারীরিক ভাবে লাঞ্চিতও হয়েছেন। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বর্ণনায় তিনি বলেন – বিগত ৩০ শে জুন ২০১১ ইং সালে আমার কর্মস্থল বড়লেখা সদরের হাজী মেমোরিয়াল মার্কেটের সামনে পরস্পর বিরোধী দুটি রাজনৈতিক দলের মিছিলের ছবি তুলতে যাই। অতঃপর রাজনৈতিক ক্যাডাররা আমাকে ঘটনাস্থলে শারিরীকভাবে লাঞ্চিত করে। আমার ডিজিটাল ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সহায়তায় আমি বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে সক্ষম হই। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের অপরাধে আমার উপর দুইটি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়।
কাজী রমিজ ২০০৬ ইং সালে ৪নং উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের নিকাহ্ রেজিষ্ট্রারের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে তার পিতার স্থলাভিষিক্ত হন এবং অদ্যবধি বহাল আছেন। স্বপ্ন মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায় সুন্দর আগামীর পথে। অজানাকে জানার অদম্য কৌতুহলী, শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী, সামাজিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি আর পেশাদারিত্বের প্রশ্নে অবিচল জীবনাদর্শে বিশ্বাসী কাজী রমিজ একজন স্বাপ্নিক। তিনি স্বপ্ন দেখেন- তরুন সমাজকে নিয়ে। তরুনদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্য দিয়েই একটি কলুষমুক্ত সমাজ গঠন করা সম্ভব। কেননা তরুনরাই একদিন সমাজের দায়িত্ব নেবে। তরুনরা ঐক্যবদ্ধ হলে অসাধ্য কাজও অনায়াসে সম্পন্ন করা সম্ভব। তাই তিনি পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তরুনদেরকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর অনুপ্রেরণা ও সহযোগীতায় এগিয়ে চলেছে এ জনপদের সর্ববৃহৎ স্বেচ্ছারক্তদাতা সংগঠন দৌলতপুর রক্তদাতা সংস্থা। দিশারী সমাজ কল্যাণ পরিষদ, সিলেটস্থ বড়লেখাবাসীর অন্যতম প্লাটফর্ম বড়লেখা ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন সহ আরো অনেকগুলো সংগঠনের সাথে তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুবক রয়েছেন।
সুবিধাবঞ্চিত ও নির্যাতিত একজন মফস্বল সাংবাদিক হওয়া সত্বেও কাজী রমিজ, জালালাবাদ এসোসিয়েশন-ঢাকা, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি- মৌলভীবাজার ইউনিট এবং সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ এর আজীবন সদস্য হিসেবে যুক্ত আছেন। এছাড়াও সদস্য হিসেবে যুক্ত রয়েছেন বড়লেখা প্রেসক্লাব, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি এবং বড়লেখা লায়েন্স ক্লাবের সাথে। খেলাধুলা ভ্রমণ ও সৃজনশীল সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে উদার মানসিকথায় বিশ্বাসী কাজী রমিজ অসহায় দুস্থ মানুষের কল্যাণের কথাও চিন্তা করেন। দুর্গত মানুষের পাশে তিনি ছুটে যান। কখনও নিজের ক্ষুদ্র সামর্থের মাধ্যমে আবার কখনও প্রবাসী বন্ধুবান্ধব এবং উন্নয়নমূলক সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থের মাধ্যমে বাড়িয়ে দেন সহায়তার হাত।
গরীব দুস্থদের কল্যাণের লক্ষ্যে তিনি একটি কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। তিনি স্বপ্ন দেখেন তার মরহুম বাবা মার নামে গঠিত এই আফসার-রায়না ট্রাষ্ট একদিন অসহায় মানুষের সেবা দান করবে। তারুণ্যের কবি সুকান্ত ভট্রাচার্য্য তাঁর কবিতায় বলেছিলেন-
‘এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান।
তবু যতক্ষন দেহে আছে প্রান প্রাণেপনে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল।
এ পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি
নব যাতকের কাছ এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”
তরুনদের অগ্রাধিকার এবং নিত্য নতুনত্বের পথে স্বাগত জানানোর এই আহবান আজও নীরবে ডুকরে কাঁদে। আর আমাদের কিছু সংখ্যক সমাজপতিরা বরাবরই পশ্চাৎপদতায় মত্ব। পুরোনো জীর্ণতা-র্শীর্ণতায় নয়, প্রগতির পথ আসে উচ্ছলতায়, নতুনত্বে। সকল বন্ধুর পথ পরিক্রমা পাড়ি দিয়ে আলোক পথের অভিযাত্রী একজন কাজী রমিজের স্বপ্ন-সাধনা নিয়ে আসুক প্রগতির পথে এগিয়ে যাবার দুর্নিবার প্রেরনা।